আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানান ধরণের সমস্যায় ভুগি । যে সমস্যায় আমরা প্রায় সবাই পড়ি তা হল সম্পর্ক । বন্ধুর সাথে সম্পর্ক , বান্ধবীর সাথে সম্পর্ক । বাবা মা, ভাই বোন থেকে শুরু করে কাঁচা বাজারের সব্জি বিক্রেতা সবার সাথেই সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । আপনাদের সবার পরিচিত এমন অনেক বন্ধু বা আত্নীয় আছে দেখবেন তারা খুব জুয়েল হয় । যেমন – আপনি হয়ত কোন বদরাগী কোন মানুষের সামনে যেতে ভয় পান । কিন্ত সেই জুয়েল লোকটি তার সাথে অবলীলায় হাসি তামাসা করে । যা করার কথা হয়ত আপনি কোনদিন চিন্তাই করেননি । তাহলে আপনার পরিচিত সেই জুয়েল লোকটি কিভাবে তা করে ? আজ থেকে যদি আপনিও তাই পারেন তাহলে কেমন লাগবে আপনার ? কি বিশ্বাস হচ্ছে না ? আজ তাই আপনাদের সামনে উপস্থাপন করব ।
ডেল কার্নেগীর নাম আপনারা সবাই জানেন । তার অমূল্য বইখানি ফুটপাতে খুব কম মূল্যে বিক্রি হয় । তিনি খুব চমৎকার ভাবে এর সমাধান দিয়ে গেছেন । ১৮৮৮ সালে আমেরিকায় জন্ম তার । এরকম বিরল প্রতিভার মানুষকে ধন্যবাদ দিলেও কম হয়ে যায় । আর ঐশী পাবলিকেশন্স ও ফারুক নওয়াজ ভাইকে ধন্যবাদ জানাই তার অমূল্য বইটি বঙ্গানুবাদ করার জন্য । সেই সাথে ক্ষমাও চেয়ে নিচ্ছি ।
অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখুন –
মনে রাখবেন অপর ব্যক্তি হয়ত সম্পূর্ণ ভুল করতে পারে । তবে তা সে মনে করে না । এজন্য তাকে দোষ দিবেন না । যে কোন বোকাই এটা করতে পারে । তাকে শুধু বোঝার চেষ্টা করুন । একমাত্র বুদ্ধিমান , সহনশক্তিসম্পন্ন , আলাদা ধরণের মানুষই এটা করে থাকেন ।
অন্য ব্যক্তি যে এরকমভাবে কাজ করে তার একটা কারণ আছে । সেই গোপন কারণটা খুঁজে বের করুন । তাহলেই তার এরকম ব্যবহারের কারণ বা হয়ত তার ব্যক্তিত্বের কথাটাই বুঝতে পারবেন । দয়া করে সততার মধ্য দিয়ে তার জায়গায় নিজেকে রাখুন । আপনি যদি নিজেকে বলেন, ‘আমি যদি ওর জায়গায় থাকতাম তাহলে আমার অনুভুতি কেমন হত বা কিভাবে চলতাম ?’ এরকম করতে পারলে আপনি প্রচুর বিরক্তি আর সময় বাঁচাতে পারবেন । কারণ কারণটা খুঁজে পাওয়ার জন্য আগ্রহী হওয়ায় তার ফলের জন্য ততটা বিরক্ত আমরা হব না । আর এছাড়াও এতে আপনি মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপনার দক্ষতা প্রচুর বাড়াতে পারবেন ।
কেনেথ এম গুড তার ‘How to turn people into gold’ বইতে লিখেছেন, ‘এক মিনিট অপেক্ষা করে দেখুন আপনার নিজের কাজে আপনার উৎসাহ কতটা আছে । তুলনা করে দেখুন অন্য কোন ব্যাপারে আপনার উৎসাহ কতটা কম । এবার বুঝে দেখুন পৃথিবীতে অন্য যে কোন লোকই ঠিক এইরকমই ভাবে । তারপর লিঙ্কন আর রুজভেল্টের সঙ্গে আপনি আয়ত্ত করতে পারবেন যে, মানুষের সঙ্গে ব্যবহার নির্ভর করে অপর লোকটির দৃষ্টিকোণ বুঝে নেবার আন্তরিকতার উপরেই।’
বেশ কয়েক বছর ধরে আমি অবসর কাটাতে চেয়েছি আমার বাড়ীর কাছাকাছি একটা পার্কে বেড়িয়ে আর ঘোড়ায় চড়ে । আগেকার কালের সেই গলদের মতই আমি একটা ওক গাছকে দারুণ ভালবাসতাম । তাই প্রত্যেক বছরে অপ্রয়োজনীয় আগুন লেগে ছোট ছোট গাছ পুড়ে যেতে দেখে আমি খুব কষ্ট পেতাম । এই অসাবধানী ধূমপানকারীদের জন্য লাগত না । এটা লাগত ছোট ছোট ছেলেরা গাছের তলায় আগুন লাগিয়ে ডিম ভেজে খাওয়ার জন্য । মাঝে মাঝে এই আগুন এতই বিরাট আকার ধারণ করতো যে ফায়ার ব্রিগেডকে তার মকাবেলা করতে হত । পার্কের এক কোনে বোর্ডে অবশ্য লেখা ছিল যে, কেউ কোন আগুন জ্বালালে জরিমানা বা কারাদণ্ড হতে পারে । কিন্তু নোটিশটা পার্কের এমন জায়গায় টাঙ্গানো ছিল যে ছেলেরা কেউই সেটা দেখতে পেত না । একজন ঘোড়সওয়ার পুলিশই পার্কের এসব তত্ত্বাবধান করত । কিন্তু সে তার কর্তব্য তেমন গুরুত্ব সহকারে করত না । আর আগুনও যথারীতি জ্বলত প্রতি ঋতুতেই । একবার আমি আগুন লক্ষ্য করে পুলিশটির কাছে ছুটে গিয়ে তাকে আগুনের কথা বলে দমকলে খবর দেবার কথা বললাম । পুলিশটি অম্লানবদনে উত্তর দিল আগুন লাগলে খবর দেয়া তার কাজ নয় ! আমি প্রায় মরিয়া হয়ে উঠলাম আর এরপর যখন ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতাম ছেলেদের আগুন জ্বালাতে দেখলেই তাদের তাড়া করতাম । আমি লজ্জিত ও গোঁয়ার ছেলেদের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা দেখিনি । আমি স্বনিয়োজিত আইন রক্ষক হয়েই কাজ করতে চাইতাম । আগুন জ্বালাতে দেখলে আমার মন এমনই খারাপ হয়ে উঠত যে ঠিক করার বদলে ভুলই করে বসতাম । আমি কর্তৃত্ব ব্যঞ্জকস্বরে ছেলেদের সতর্ক করে বলতাম যে এজন্য তাদের জরিমানা আর জেলও হতে পারে । তাদের গ্রেপ্তারের ভয়ও দেখাতাম । আমি কেবল নিজের মনকেই হাল্কা করতে চাইতাম, তাদের মন বিচার করতাম না ।
ফলাফল কি হল ? ছেলেরা কথা শুনত – বেশ অসন্তুষ্ট হয়েই মেনে নিত । আমি পাহাড়ে ঘোড়ায় চড়ে উঠে গেলে আমার ধারণা তারা আবার আগুন জ্বালাত আর বোধহয় সারা পার্কটাই পুড়িয়ে ছাই করতে চাইত ।
সময় কেটে চললে আমি আশা করলাম মানবিক সম্পর্ক নিয়ে আমার নতুন কিছু জ্ঞান সঞ্চয় হয়েছে । এবার একটু কৌশলী হই, আর অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে সব কিছু দেখতে অভ্যস্ত হই । এর ফলে হুকুম দেবার বদলে জ্বলন্ত আগুন দেখে এগিয়ে গিয়ে অনেকটা এইভাবে শুরু করতামঃ-
“কি ছেলেরা, সময় ভাল কাটছে ? আর কি রান্না হচ্ছে ? ... ছেলে বয়সে আমরাও আগুন ধরাতাম, এখনো আগুন ধরাতে ভাললাগে । কিন্ত তোমরা বোধহয় জান না বাগানে আগুন জ্বালানো খুব বিপদজনক । আমি অবশ্য জানি, তোমরা কোন অনিষ্ট করতে চাওনা । তবে অন্য ছেলেরা সেরকম সাবধানী নয় । ওরা তোমাদের আগুন জ্বালাতে দেখে আগুন জ্বালায় অথচ খাওয়ার পর নিভিয়ে যেতে ভুলে যায় । আর সেটা শুকনো পাতায় লেগে সব গাছ পুড়িয়ে ফেলে । তবে আমি কোন হুকুম করে তোমাদের আনন্দ মাটি করতে আসিনি । আমি চাই তোমরা আনন্দ কর । তবে দেখ, তোমরা শুকনো পাতাগুলো এখনই আগুনের কাছ থেকে সরিয়ে নাও, আর যাওয়ার সময় ধুলোয় আগুনটা চাপা দিতে ভুলে যেও না । করবে তো এটা ? এরপর যখন আনন্দ করতে চাইবে পাহাড়ের উপর যেখানে বালি আছে সেখানে ধরালে কেমন হয় ! তাতে কোন ক্ষতিও হবে না । তাছারা এখানে আগুন জ্বালালে জেলও হতে পারে । ... তোমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ । আচ্ছা এবার আসি । তোমরা আনন্দ কর ।”
এধরনের কথায় কত তফাৎ ঘটে যায় । এর ফলে ছেলেরা সহযোগিতা করতে চায় । কোন বিরক্তি বা অসহিষ্ণুতা তাদের মধ্যে থাকে না । তাদের হুকুম করে বন্ধ করতে হয় না । কারণ তারা তাদের মুখ রক্ষা করতে পেরেছে এই চিন্তাই তাদের মন ভাল রাখে অনিষ্ট করা থেকে বিরত রাখে এবং তাদের বন্ধুদেরকেও তারা সাবধান করে দেয় । আর আমিও ভাল থাকি । আমি তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা দেখতে চেয়েছিলাম এবং সেভাবেই অবস্থাটা সামাল দিয়েছি ।
এর পরের বার কাউকে ঐ আগুন নেভানোর কথা বলার বা অন্য কাজ করানোর আগে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা একটু চোখ বন্ধ করে দেখে নিন । এটা করলেই ভাল নয় কি ? নিজেকে প্রশ্ন করুনঃ ‘লোকটি একাজ করতে চায় কেন ?’ এটা সত্যি যে এতে সময় লাগবে । তবে তাতে নতুন বন্ধু পাবেন । ঝগড়া রেষারেষির বদলে ভাল ফলও পাবেন । জুতোর তলাও কম ক্ষয় হবে ।
হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের ডিন, ডনহ্যাস বলেছিলেন, ‘কারও অফিসে গিয়ে তার সাথে দেখা করার আগে অফিসের সামনের রাস্তায় দুঘণ্টা পায়চারী করতে চাই, কিন্তু কোন পরিষ্কার ধারণা না নিয়ে ঢুকতে চাই না । যেমন আমি কি বলব তারই বা উত্তর কি হবে । যার কাছে যাব তার দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে । তার সম্বন্ধে যতটা পারা যায় জেনে রাখাই শ্রেয় ।’
কথাটা এতই দামী যে বারবার সেটা মনে রাখা দরকার ।
এই লেখা পড়ার পর যদি সর্বদা সবকিছু অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অভ্যাস জন্মায় তাহলে এটা নিঃসন্দেহে আপনার জীবনে হয়ে উঠবে একটা দিগ দর্শন আর সুন্দর কোন অভিজ্ঞতা ।
তাই অন্যের বিরক্তি না জাগিয়ে মানুষকে যদি পরিবর্তন করতে চান তাহলে নিয়ম হলঃ
‘আন্তরিকভাবে অপরের দৃষ্টিকোণ থেকেই সব কিছু দেখার চেষ্টা করুন ।’